বিসিএস প্রিলি বা রিটেন পরীক্ষা যেটাই বলেন না কেন বিসিএস পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বরের পার্থক্য সৃষ্টিকারী বিষয় ‘গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা’। তাই ক্যাডার হওয়ার দৌড়ে নিজেকে এগিয়ে রাখতে এই ২ টি বিষয়ে জোরদিয়ে ৪৭ তম বিসিএস প্রস্তুতি নিতে পরিকল্পিতভাবে পড়াশোনা করতে হবে।
গণিতের নাম শুনে আমাদের অনেকের গায়ে জ্বর আসলেও চাকরি পেতে হলে গণিত সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকতেই হবে। কারণ প্রায় সব চাকরির পরীক্ষাতেই গণিতের উপর প্রশ্ন করা হয়। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেও বড় একটা অংশ জুড়ে আছে গণিত। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় গণিত বিষয়টি দুইটি অংশে বিভক্ত। গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা। দুই অংশ মিলে ৩০ নম্বরের প্রশ্ন থাকবে।
গাণিতিক যুক্তি নিয়ে অনেক চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে অহেতুক ভীতি কাজ করে। এই ভয়কে জয় করতে হলে গণিতের মৌলিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে হবে। আর তাই গণিতের প্রস্তুতি হতে হবে বোর্ড বইভিত্তিক। শুরুতেই পিএসসি গাণিতিক যুক্তির সিলেবাস দেখে নিতে হবে। সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো মাধ্যমিক পর্যায়ের বোর্ড বইগুলো থেকে অনুশীলন করতে হবে। সপ্তম, অষ্টম শ্রেণির গণিত বোর্ড বই এবং নবম-দশম শ্রেণির সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিত বোর্ড বই থেকে সিলেবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধ্যায়গুলো খুব ভালোভাবে চর্চা করতে হবে। এতে সময় কিছুটা বেশি লাগলেও ফল খুব ভালো পাওয়া যাবে। কারণ, বিসিএস লিখিততেও ৫০ নম্বরের গণিত পরীক্ষা আছে। লিখিতের বেশির ভাগ প্রশ্নই বোর্ড বইভিত্তিক থাকবে। তাই বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় গাণিতিক যুক্তিতে ভালো নম্বর পেতে বোর্ড বইগুলো চর্চা করার কোনো বিকল্প নেই।
প্রিলিমিনারির গণিতে ভালো করতে হলে প্রতিটি অঙ্কের শর্ট টেকনিক জানতে হবে। এতে খুব অল্প সময়ে গণিতের সমাধান করা যাবে। পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি ও উচ্চতর গণিতের সব সূত্র নোট করে বারবার পড়তে হবে। সূত্র মুখস্থ করা ছাড়া কম সময়ে গণিতের সমাধান করা বেশ কঠিন।
৪৭ তম বিসিএস গণিত প্রস্তুতি গাইডলাইন (47 BCS preparation math)
গণিত ভীতি কম বেশি সবারই আছে। বিসিএস এর মত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মাথা ঠান্ডা করে গণিতে ভাল নম্বর খুব কম প্রার্থীই পেয়ে থাকে। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতে যেসব বিষয়ে আপনাকে পারদর্শী হতেই হবে এর মধ্যে গাণিতিক যুক্তি অন্যতম। কারণ প্রিলিতে গণিতে ভালো প্রিপারেশন নিলে লিখিত পরিক্ষায়ও ভাল নম্বর পাওয়া যায়। বিসিএস গণিত সিলেবাস খুবই স্পেসিফিক। তাই বিসিএস গণিত প্রস্তুতি নিতে সিলেবাস ধরে ধরে টপিক অনুসারে নিজের দুর্বলতা ও দক্ষতা খুঁজে বের করতে হবে। সুশৃঙ্খলভাবে পরিকল্পনা করে অনুশীলন করলে সাফল্য আসবেই।
গাণিতিক যুক্তি অংশে বাস্তব সংখ্যা, ল.সা.গু, গ.সা.গু, শতকরা, সরল ও যৌগিক মুনাফা, অনুপাত ও সমানুপাত, লাভ ক্ষতির উপর ৩ মার্ক, বীজগাণিতিক সূত্রাবলি, বহুপদী উৎপাদক, সরল ও দ্বিপদী সমীকরণ, সরল ও দ্বিপদী অসমতা, সরল সহসমীকরণের উপর ৩ মার্ক, সূচক ও লগারিদম, সমান্ত ও গুনোত্তর ধারার উপর ৩ মার্ক, রেখা, কোণ, ত্রিভুজ ও চতুর্ভুজ সংক্রান্ত উপপাদ্য, পিথাগোরাসের উপপাদ্য, বৃত্ত সংক্রান্ত উপপাদ্য, পরিমিতির উপর ৩ মার্ক, সেট, বিন্যাস ও সমাবেশ, পরিসংখ্যান ও সম্ভাব্যতার উপর ৩ মার্ক মিলিয়ে মোট ১৫ নম্বরের প্রশ্ন থাকবে।
৪৭ তম বিসিএস গণিত সিলেবাস ও মানবন্টন
গাণিতিক যুক্তি (মার্ক- ১৫):
- পাটিগণিত (৩ নম্বর)
- বীজগণিত (৬ নম্বর)
- জ্যামিতি (৩ নম্বর)
- বিচ্ছিন্নগণিত (৩ নম্বর)
রেফাররেন্স বুকঃ
- ৮ম, ৯ম-১০ম শ্রেণির বোর্ড বই
- উচ্চতর গণিত থেকে কিছু টপিক্স সিলেবাস দেখে
- উচ্চ মাধ্যমিক গণিত (বিন্যাস, সমাবেশ, সম্ভবতা, সূচক, লগারিদম)
- সাইফুরস ম্যাথ / খাইরুলস ম্যাথ
- বিগত বছরের প্রিলি ও রিটেন সল্ভ
তাছাড়া আপনি অনুশীলনের জন্য গাইড বই ফলো করতে পারেন। (যেমনঃ এম্পিত্রি / কনফিডেন্স)
সিলেবাস ও মানবন্টন:
পাটিগণিত (৩ নম্বর)
- বাস্তবসংখ্যা
- লসাগু ও গসাগু
- শতকরা
- সরল ও যৌগিক মুনাফা
- অনুপাত ও সমানুপাত
- লাভ – ক্ষতি
বীজগণিত (৬ নম্বর)
- বীজগাণিতিক সূত্রাবলী
- বহুপদী উৎপাদক
- সরল ও দ্বিপদী সমীকরণ, দ্বিপদী অসমতা, সহসমীকরণ
- সূচক ও লগারিদম
- সমান্তর ও গুণোত্তর ধারা
জ্যামিতি (৩ নম্বর)
- রেখা ও কোন
- ত্রিভুজ ও চতুর্ভুজ সংক্রান্ত উপপাদ্য
- পিথাগোরাসের উপপাদ্য
- বৃত্ত সংক্রান্ত উপপাদ্য
- পরিমিতি- সরলক্ষেত্র ও ঘনবস্তু
বিচ্ছিন্নগণিত (৩ নম্বর)
- সেট
- বিন্যাস ও সমাবেশ
- পরিসংখ্যান
- সম্ভাব্যতা
এই অধ্যায় ছাড়াও কিছু কিছু টপিক থেকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করা হয়। যেমনঃ
- ঐকিক নিয়ম
- ট্রেন ও গতিবেগ
- নৌকা ও স্রোত
- নল ও চৌবাচ্চা
- সময়, দূরত্ব ও গতিবেগ
- কাজ ও দিন
- মিশ্রণ
গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়
গাণিতিক যুক্তির অধ্যায়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাটিগণিতের লসাগু ও গসাগু, শতকরা এবং সরল ও যৌগিক মুনাফা থেকে বেশি প্রশ্ন এসেছে। এ ছাড়া বাস্তব সংখ্যা, অনুপাত-সমানুপাত ও লাভ-ক্ষতি থেকেও কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। বীজগণিতের অধ্যায়গুলোর মধ্যে বীজগাণিতিক সূত্রাবলি, সূচক ও লগারিদম, সমান্তর ও গুণোত্তর ধারা এবং সরল ও দ্বিপদী অসমতা থেকে প্রতি বিসিএসেই প্রশ্ন আসে। তবে বীজগণিতের বহুপদী উৎপাদক, সরল ও দ্বিপদী সমীকরণ ও সরলসহ সমীকরণ থেকে খুব কম প্রশ্ন আসে। জ্যামিতির রেখা, কোণ, ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজসংক্রান্ত উপপাদ্য থেকে বেশি প্রশ্ন আসে। এ ছাড়া সেট, সমাবেশ ও সম্ভাব্যতা থেকে প্রচুর প্রশ্ন আসে। অসমতা, ত্রিকোণমিতি, বিন্যাস, জটিল সংখ্যা, পরিসংখ্যান ও পরিমিতি থেকে তুলনামূলক কম প্রশ্ন আসে।
পরীক্ষার কক্ষে ক্যালকুলেটরের সাহায্য ছাড়াই গণিতের সমাধান বের করতে হবে। তাই আগে থেকে ক্যালকুলেটর ছাড়া গণিত সমাধান করার অনুশীলন করুন। যেহেতু গণিতের উত্তর করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ, তাই বিসিএস প্রিলিমিনারিতে সবশেষে গণিত উত্তর করা উচিত। গণিতে দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত মডেল টেস্ট পরীক্ষা দিতে হবে। এতে নিজের সবলতা-দুর্বলতা শনাক্ত করা যাবে এবং দ্রুত সমাধান করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
কিছু পরামর্শঃ
👉 বিসিএস গণিতে ভালো করার একটিমাত্র উপায় প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস এবং প্র্যাকটিস। আপনি যদি গণিতে দুর্বল হয়ে থাকেন তাহলে গুরুত্ব সহকারে প্রতিদিন প্র্যাকটিস করুন। গণিতে আপনার অবস্থা যেমনই হোক না কেন, এর জন্য নিয়মিত কিছু সময় বরাদ্দ রাখুন।
👉 প্রস্তুতির (BCS prostuti) শুরুতেই প্রথমে নিজের লেভেলটা যাচাই করুন। যদি দক্ষতার লেভেল খুব দুর্বল থাকে, তাহলে পঞ্চম শ্রেণির বই দিয়ে প্রস্তুতি শুরু করতে পারেন।
ক্যালকুলেটর ছাড়া অঙ্ক করার অভ্যাস করুন।
👉 সিলেবাস (BCS Math Syllabus) ধরে ধরে অধ্যায়ভিত্তিক অনুশীলন করুন। গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোর ওপর বাড়তি নজর দিন।
👉 বোর্ড বই শেষ করে বিগত বছরের প্রশ্ন ও বাজারের প্রচিলিত যেকোনো ভালো মানের গাইড বই অনুশীলন করুন।
👉 পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য বিগত বছরগুলোর বিসিএস প্রশ্নগুলো সমাধান করুন। যে ধরনের অংক জটিল ও সময়সাপেক্ষ মনে হবে, সেগুলো আলাদা নোট করে রাখুন।
👉 গনিতে যারা দুর্বল, তারা খাইরুল স্যারের ব্যাসিক বইয়ের সাহায্য নিতে পারেন।
যারা সম্ভাব্যতা, বিন্যাস ও সমাবেশ এ দুর্বল, তারা Youtube থেকে অন্যরকম পাঠশালা এর ভিডিওগুলো দেখতে পারেন।
👉 বিগত বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় আসা অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে তুলনামূলক বেশি ও কম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শনাক্ত করুন।
👉 ৩৫-৪৩ বিসিএস এর প্রশ্ন এনালাইসিস করে দেখা গেছে,
⇒ বীজগণিতের মধ্যে সরল ও দ্বিপদী অসমতা, বীজগাণিতিক সূত্রাবলী, লগারিদম, সূচক, গুনোত্তর ধারা, সমান্তর ধারা, সরল ও দ্বিপদী সমীকরণ এই টপিক গুলো থেকে প্রায় প্রতিবার এক বা একাধিক প্রশ্ন আসে। তাই এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
⇒ পাটিগণিতের মধ্যে ল.সা.গু / গ.সা.গু, শতকরা, সরল ও যৌগিক মুনাফা, লাভ ক্ষতি, বাস্তব সংখ্যা, অনুপাত – সমানুপাত এই টপিক গুলো থেকে প্রশ্ন আসে। তাই এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
⇒ জ্যামিতির মধ্যে কোণ, ত্রিভূজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ এই টপিক গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
⇒ সেট, সমাবেশ, সম্ভাব্যতা থেকে প্রায় প্রতিবার প্রশ্ন থাকে। তাই এগুলো খুব গুরুত্ব সহকারে পড়া উচিৎ।
⇒ রেখা, পিথাগোরাসের উপপাদ্য, পরিমিতি- সরলক্ষেত্র ও ঘনবস্তু, বিন্যাস,পরিসংখ্যান, বহুপদী উৎপাদক, সরল সহ সমীকরণ এগুলো থেকে তেমন প্রশ্ন আসে না। তাই এগুলো কম গুরুত্বপুর্ণ বলা যেতে পারে।
গণিতে ভালো করার আরেকটি অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে নিয়মিত অনুশীলন করা। প্রতিদিন অন্তত দুই ঘণ্টা হাতে-কলমে গণিত অনুশীলন করতে হবে। গণিত যত বেশি অনুশীলন করবেন, পরীক্ষায় তত বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে পারবেন। বোর্ড বই থেকে অনুশীলন করার পাশাপাশি আগের বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নগুলো নিজে নিজে সমাধান করতে হবে। প্রতিদিন অন্তত দুটি আগের চাকরির পরীক্ষার গণিত প্রশ্নের সমাধান অনুশীলন করতে হবে।
গণিতে দুর্বল এমন অনেক প্রার্থী গণিতকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নেন, যা একেবারেই কাম্য নয়। গণিত বাদ দিয়ে প্রিলিমিনারি বা লিখিত কোনোমতে পাস করা গেলেও চূড়ান্ত ফলাফলে শূন্য হাতে ফেরার সম্ভাবনা বেশি। বিসিএস ক্যাডার বা নন-ক্যাডার থেকে ভালো একটি চাকরি পেতে হলে গণিতে পারদর্শী হওয়া অপরিহার্য। তাই গণিতকে ভয় নয়, বরং উপভোগ করে নিয়মিত অনুশীলন করুন।